একগুচ্ছ কবিতা- শিশির আজম
সেতার
রবিশঙ্কর মুখে কখনো স্বীকার করেননি অন্নপূর্ণাকে খুন করা হয়েছিল
সত্যি স্বীকার করেননি
তাহলে প্রায়শ্তিত্ত কীসের জন্য
এতো এতো বছর ধরে
মৃত্যু অবধি
আর এতো এতো জমকালো কনসার্ট
কনসার্ট হলের করতালি থেমে গেলে কান পেতে কখনো শুনেছেন
ওর কান্না
ঐ সেতারের
ওর কীসের রেস্পনসিবিলিটি
কেন ও সেতু হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রোতা আর শিল্পীর মাঝে
কীসের কৈফিয়ত
অন্নপূর্ণা তো কবেই খুন হয়েছেন আর খুনী আপনিই
কি বোকা আপনি
এই সেতার যাকে আপনি দিয়েছেন আপনার একান্ত আকাশ আর দ্বীপপুঞ্জ
আর রক্ত
আর কতো কতো রাতের কষ
সেই সেতার
হ্যা সেই সেতার আপনাকে ফাঁসিয়েছে রবি দিনের পর দিন
আপনি টেরও পাননি
ফেল্লিনি
রিমিনি কখনো আমি যাইনি মানে ফেল্লিনি যেখানে জন্মেছিলেন।
‘তো?’
প্রশ্ন করতে পারো তোমরা।
আসলে উত্তরটা আমার কাছে নেই।
কেবল জানি রিমিনি কখনো আমি যাইনি, আর ফেল্লিনি
আমার বন্ধু ফেদেরিকো ফেল্লিনি
ওকে কখনো জিগ্যেসও করিনি রিমিনি শহরটা কীরকম
অথবা রোমের কাছাকাছি কি না।
যা হোক
আমি বিশ্বাস করি উনি কোনভাবেই সার্কাসের স্টেজ হিসেবে
রিমিনিকে ভাবেননি
অথবা
পুরো পৃথিবীটাকেই উনি সার্কাসের স্টেজ হিসেবে দেখেছেন
ড্রামাটিক
প্যারাডক্সিকাল এ্যান্ড আ বাঞ্চ অব স্যুরিয়াল সিকোয়েন্সেস
হয় তো
আমরা মানতে চাইনি
সীমান্ত বিষয়ে
এমন প্রায়ই হয়, তিনি আমাকে ডেকে পাঠান
এমন প্রায়ই হয়, মনে হয়েছে আমাকে না ডেকে তিনি অন্য কাউকে
ডাকতে পারতেন
এমন প্রায়ই হয়, আমি প্রতীক্ষায় থাকি তার আমন্ত্রণের
তার ছুরির
তার নীরবতার
তার কথা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি
এমন প্রায়ই হয়, আমার পছন্দ নয় এমন বিষয়েও তিনি আমাকে
আকৃষ্ট করেন।
স্বীকার করি তার বাচনভঙ্গি অতুলনীয়
হয় তো তিনি যা বলেন না সেটাও আমি শুনে থাকি।
চেতনাবোধসম্পন্ন কোন প্রাণি কি মুখ দিয়েই সব বলে না কান দিয়েই সব শোনে?
তাহলে বলুন সরাসরি আমার চোখের দিকে তার দ্বিধাহীন দৃষ্টিনিক্ষেপ
তার ঠোঁটের নড়াচড়া
তার অনিদ্রা
তার নুন
তার ফাল্গুন মাস
এগুলো কেন আমাকে ব্যাতিব্যাস্ত করে তুলবে না?
শঙ্কিত?
তিনি প্রায়ই আমার খোঁজ করেন আর আমার আগ্রহের শাখাপ্রশাখা
বাড়তে থাকে
আমি কি নিজেকে পেতে চাইছি আমাদা একটা সূর্যের আবিষ্কারক হিসেবে
আমি কি জাদুঘরের বিশাল সমারোহে চাইছি নিজেকে
লীন করে দিতে
আমার বহুমুখী স্বাধীন ইন্দ্রিয়সমূহকে তার দিকে নিয়োগ করি
টের পাই আমার ভেতর একটা আগ্নেয়গিরি আছে
একটা গুহা
একটা না লেখা বই।
তার আমন্ত্রণ আর আমার প্রতীক্ষা একটা সীমান্তের মতো
আজও আমাকে তিনি ডেকে পাঠালেন
তার কামরায়
আর যথারীতি সীমান্ত বিষয়ে কিছুই বললেন না
বলা যায় অস্বীকারই করলেন আমার নুন
আমার অসুখ
আমার আগ্নেয়গিরি।
আচ্ছা আগ্নেয়গিরি নিয়ে ভালো কোন ডকুমেন্টারি আজ অব্দি কেউ বানিয়েছেন?
সুখদুঃখের গল্প
সারাক্ষণ আমরা নিজেদের দুঃখ নিয়ে থাকি
সারাক্ষণ
আমরা ভাবি অন্যরা কত সুখী
কেন আমরা আকাশের কাছে বসে থাকি
আকাশের কত কত তারা
ওদের ক’জনকে আমরা চিনি ক’জনের ঠোঁটে অঘ্রাণের ঘ্রাণ
পাওয়া যায়
অথবা আমরা কি জানি কার হাটুর ব্যথা
কার বুকের কাঁটার কাছে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে
যখন আমাদের আর কোথাও কিছু থাকে না
না ট্রেন
না পিঁপড়ের সারি
তখন আমরা সমুদ্রের কাছে যাই
যদি পাই
একটু শান্তি একটু স্বস্তি
সমুদ্র কি বিশাল
আর তার বিপুল জলরাশিই পারে আমাদের দুঃখ ধুয়ে দিতে
কিন্তু এই বিশাল সমুদ্রে
কে ঢেলে দিয়েছে নুন
না কি এ অশ্রু
কার অশ্রু
কার দুঃখ বুকে নিয়ে সমুদ্র বেঁচে আছে আর বয়ে চলেছে
আজও
বুর্জোয়া
অনর্থক ফ্যাসাদে জড়িয়ে কাজ নেই বুঝলেন গতকাল পাজি বেড়ালটার পা ভেঙেছি – মেয়েটা নাছোড়বান্দা ওর চায় ছবিওলা বই একটা ছেঁড়ার পর আরেকটা, যেন ও ছবি আঁকতে শিখেছে, শুধু তাই না, ছবি ছিঁড়তেও শিখেছে – বউ আবার মনে করে ফি হপ্তায় একটা সন্ধ্যা নাটকে কাটানো আধুনিক রুচির পরিচায়ক, ফ্রেন্স পার্ফিউম, বুঝলেন আমার সহ্য হয় না – অফিস, পার মান্থ কমপক্ষে তিনটে ফরেন ট্যুর মন্দ না, মাঝে মাঝে সামিরা, আমার ইয়াং কলিগ, সঙ্গী হয়, মেয়েটা অফিসিয়ালি পারফেক্ট, বিছানায় টপক্লাস – কুন্তি, আমার বউ, সব জানে কিন্তু খোঁচায় না, ও জানে ও যে ধোয়া তুলসিপাতা না তার প্রমাণ আমি হাতেনাতে দিতে পারি, বুঝলেন এসব ব্যাপারে কেউ কাউকে আমরা ঘাটাই না আমরা পলিটিক্সের ফিকশান নিয়ে কথা বলি, আর্ট, হ্যা পলিটিক্সও আর্ট আর সেক্স সিম্পলি বায়োলজিক্যাল প্রসেস, তবে একইসঙ্গে তা আর্ট, এবং পলিটিক্ম, সিমন দ্য বেভোয়া বলেছেন, উনি তো আবার বন্ধু সার্ত্রের সঙ্গে লিভ টুগেদার করেছেন, মানে বিষয়টাকে ওরা সিম্পলি পলিটিক্স বলে গণ্য করেছেন যেটা আবার ম্যাক্রো ইকোনোমির বাই-প্রোডাক্ট – তো এ ব্যাপারটায় কুন্তি, সামিরা, এমন কি সামিরার অধ্যাপক স্বামী, সবাই ওয়াকিফহল, মানে বুঝুন ব্যাপারটা, আমাদের হাতে তো রক্ত লেগে নেই, আপনি সর্বশেষ তথ্যসরণীটা দেখুন, গড় আয়ূতে আমরাই এগিয়ে।
আরও পড়ুন- মির্জা গালিবের শায়েরী