সৃষ্টি- তারিক অনিকেত- গল্প

ক’দিন হল বন্ধুদের আড্ডায় যাচ্ছি না। কাজের সময়টুকু ছাড়া বাকিটা সময় ঘরেই কাটাই। রুমিকে সঙ্গ দিই। রুমি বেশ খুশি। ঝটপট রান্নার কাজটা সেরেই আমার কাছে এসে বসে। অবসরে গল্প উপন্যাস পড়া আমার হবি। এখন ছড়া-পদ্য লেখার চেষ্টা করছি। অন্ত্যমিলটা ঠিক থাকলেও মাত্রা ঠিক থাকছে না। মাত্রা সম্পর্কে জানিও খুব কম। অর্থ্যাৎ মাত্রাজ্ঞানের অভাব। এরকম একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানোর সময় রুমি এসে আমার পাশে বসে উঁকি দিয়ে দেখে আমি কী লিখছি। আপন মনে বলি, ‘বাংলা কবিতার ছন্দ সংক্রান্ত একটা বই কিনতে হবে।’ রুমি কিছু বলে না। সেও কাহজ কলম টেনে নেয়। আঁকিবুঁকি কাটে। এক সময় কাগজে সুন্দর হয় এবং আধুনিক কতগুলো নাম লিখে। একপাশে ছেলেদের, আরেকপাশে মেয়েদের। সে আমাকেও দু’একটিনাম বলতে বলে। আমি বললাম, ‘প্রদীপ।’ রুমি জিজ্ঞেস করে, ‘কেন, প্রদীপ কেন?’ আমি হেসে উত্তর দিই, ‘আমাদের প্রথম সন্তান তো! হয়ত বা একমাত্র। আমাদের বংশের প্রদীপ।’ রমির মুখটা থমথমে গম্ভীর। বলে, ‘আমি তো এখনো আল্ট্রাসোনোগ্রাফী করাইনি। জানিও না গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে। মেয়ে হলে প্রদীপ হবে কীভাবে?’ আমি রুমিকে আশ্বস্ত করি, ‘মেয়ে হলেও দুঃখ নেই। মেয়েটাই আমাদের বংশের প্রদীপ হয়ে জ্বলবে। তুমি আদিবাসীদের দেখছো না! অধিকাংশই মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।’

মাঝে মধ্যে রুমিকে নিয়ে বিকেলে বেড়াতে বের হই। কখনো পার্কে। কখনো নদীতীরে। আমাদের জেলাশহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বইমেলা শুরু হয়েছে। চলবে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ভাবছি, রুমিকে নিয়ে মেলায় যাব।

মেলার গেট দিয়ে ঢোকার সময় রুমি প্রস্তাব দেয়, ‘আজ আমরা আলাদা হয়ে ঘুরে বেড়াই। এক ঘন্টা পর এই গেটের কাছে এসে দু’জনে একত্র হব।’ ওর কথায় আমি একটু ভড়কে যাই। একটা হাত ধরে বলি, ‘এই অবস্থায় তুমি একা হাঁটতে পারবে?’ রুমি আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। বলে, ‘ভয় পেয়ো না। আমি তোমার প্রদীপের কোনো ক্ষতি করবো না।’ আমি ছোট্ট করে ‘ভালো থেকো’- বলে ভিড়ের ভেতর মিশে যাই।

এ স্টল, সে স্টল ঘুরে শেষ পর্যন্ত রুমির জন্য একটা বই কিনি। একজন বিখ্যাত চিকিৎসকের লেখা বই, ‘গর্ভাবস্থায় মেয়েদের যত্ন’। দোকানী বইটা প্যাকেটে ভরার আগেই আমি পকেট থেকে পেন বের করে ভেতরের পৃষ্ঠায় একটা লিখে দেই- ‘রুমিকে, সৃষ্টির তরে।’

এক ঘন্টা পেরোবার আগেই আমি মেলার গেটের কাছে চলে আসি। একটু পরে রুমিও ফিরে আসে। তার হাতেও একটা বইয়ের প্যাকেট। বাসায় ফেরার জন্য রিক্সা নিই। রিক্সায় চড়েই আমরা প্যাকেট বদল করি। রুমির উপহারের প্যাকেটটা খুলি আমি। সে আমার জন্য কিনেছে আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখা ‘ছন্দ’ বইটা। দেখে আমার এতো খুশি লাগে! বইটা বেশ কাজে লাগবে। মলাট ওল্টাতেই গোটা গোটা অক্ষরে রুমির হাতের লেখা- ‘তোমাকে সৃষ্টির উদ্যমে।’

লেখাটা পড়ে আমি চমকে উঠি। আমরা দু’জনেই সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত। তবে রুমির সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত। তবে রুমির সৃষ্টিতে মৃত্যুঝুঁকি আছে। আমারটায় নেই।

আরও পড়ুন- এখন অভিশপ্ত বাড়ি