সালতামামির পঙক্তিমালা- বই রিভিউ

গ্রন্থের নাম: সালতামামির পঙক্তিমালা

গ্রন্থের ধরণ: কাব্য

রচয়িতা: কবি টিটো মুস্তাফিজ

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান: রচয়িতা,  উত্তরা,  ঢাকা

প্রচ্ছদ ও বিন্যাস: লুৎফুল হোসেন

প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী,  ২০১৯

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬৩

মুদ্রিত মূল্য: ১৫০/- টাকা

রেটং: ৩.৫/৫

 

কবি পরিচিতি:

সমকালীন বাংলা সাহিত্যকে নিঃস্বার্থভাবে যে কজন কবি সাহিত্যিক সমৃদ্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের একজন কবি টিটো মুস্তাফিজ। বাংলা সাহিত্যের জগতে তাঁর পদার্পণ নতুন হলেও এরই মধ্যে নিজের অবস্থান বেশ দৃঢ় করেছেন হাইকু লিখে জনপ্রিয়তা পাবার মধ্য দিয়ে।

কবি টিটো মুস্তাফিজ, ছবি- Facebook

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার মাড়িয়া গ্রামে জন্ম নেয়া এই কবি বর্তমানে কর্মরত আছেন নাটোর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক হিসেবে।

পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ এবং পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। রসায়নে পড়াশোনা করা এই কবি তাঁর প্রতিটি কবিতায় শব্দের রসায়ন বেশ ভালো ভাবেই করেছেন।  এ পর্যন্ত তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।  যথা:-

১) সালতামামির পঙক্তিমালা

২) হাইকু অভিযাত্রা

এছাড়াও দেশি বিদেশি বহু ম্যাগাজিন (যার মধ্যে অলপোয়েট্রি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য)  তার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। বাংলায় কবিতা ও হাইকু লেখার পাশাপাশি সমানতালে ইংরেজি ভাষায় কাব্য রচনা করে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন অগণিত পাঠকের।  দেশে এবং বিদেশে তৈরি করছেন শুভাকাঙ্ক্ষী।  কবি টিটো মুস্তাফিজ কাব্য চর্চা ছাড়াও নিয়মিত ক্যাডেট কলেজ ব্লগে লেখালেখি করেন। যুব আমন্ত্রণ প্রশিক্ষণে জাপান সফরের সময় কবিতার ক্ষুদ্রতম রুপ হাইকুর প্রতি আকৃষ্ট হোন।  উল্লেখ্য,  কবি একজন দক্ষ অনুবাদকও বটে।  তাঁর অনূদিত কবিতাগুলো সমালোচক মহলে  বেশ প্রশংসিত।

গ্রন্থের নামকরণের সার্থকতা:

কবি তাঁর গ্রন্থের নাম দিয়েছেন সালতামামির পঙক্তিমালা। সালতামামি শব্দের অর্থ বছরের হিসাবনিকাশ বা বার্ষিক বিবরণী। নামকরণ দেখলেই অনায়াসে বলা যেতে পারে যে, কবি সারা বছরের লেখা কবিতাগুলো এই গ্রন্থে জায়গা দিয়েছেন। কাব্যগ্রন্থকে তিনি নির্দিষ্ট কোন ক্যাটাগরিতে আবদ্ধ রাখেননি। সুঁতা কাটা ঘুড়ির মত কবিতাগুলো ছিল মুক্ত, স্বাধীন। মোট তিনটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত কবিতাগুলোয় জায়গা পেয়েছে নানা ধাঁচের,  নানা ঢং-এর কবিতা।  যেমন- গদ্য কবিতা, দ্বিপদী, অনুবাদ, হাইকু, লিমেরিক,  রুবাই, চতুষ্পদী কবিতা।

সুতরাং কাব্যগ্রন্থটির বিষয়বস্তু ও বিন্যাসের পর্যালোচনা করে নামকরনের সার্থকতা প্রতিয়মান হয়।

গ্রন্থের বিষয়বস্তু:

সালতামামির পঙক্তিমালা গ্রন্থটি মোট তিনটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত। যথা-

১) দাসের আত্মকথা

২) হাইকু

৩) সালতামামির পঙক্তিমালা

ছোট বড় মিলিয়ে মোট ৬৮টি কবিতা ও ২৭টি হাইকু নিয়ে সাজানো হয়েছে ৬৩ পৃষ্ঠার এই ছোট্ট কাব্যগ্রন্থটি। দৃষ্টি নন্দন প্রচ্ছদ, পরিচ্ছেদের শুরুর পাতায় আকর্ষণীয় চিত্রকর্ম আর ঝকঝকে গোটা গোটা অক্ষর পাঠককে মুগ্ধ করবে। কবি যেন বৃত্তের কেন্দ্র থেকে পরিধি ঘিরে নিজের অনুভূতি, দর্শন, আদর্শ এবং অভিজ্ঞতার শব্দমালার এক পৃথিবীতে আবর্তন করছেন। প্রতিটি কবিতাই তাই মনে হবে জীবন ঘনিষ্ঠ, চির পরিচিত, চির চেনা।

রুশিয়া জামান, ছবি- Facebook

প্রথম অংশ বা পরিচ্ছেদ “দাসের আত্মকথা”য় আছে বিভিন্ন কবিতা, ৫টি অনূদিত কবিতা, লিমেরিক এবং ছোট ছোট দ্বিপদী কবিতা। মানব জীবন মূলত অন্যের সেবায় নিয়োজিত -এ উপলব্ধি থেকে প্রেম, বিরহ, বিক্ষোভ, সমাজচিত্র এইসব এসেছে তার মৌলিক কবিতা এবং লিমেরিক। কৃষ্ণচূড়ার ফুলে কবি বিনে সুতার মালায় জড়িয়েছেন পুরো অংশ জুড়ে। তবে, সারা জাগানো কবিতা তার দাসের আত্মকথা। গ্রন্থের শুরুতেই প্রকান্ড শ্বেত পাথরের রাজপ্রাসাদের মতো দেখা মিলবে দাসের আত্মকথার। আড়াই পৃষ্ঠার এই কবিতাটিকে কবির রচিত শ্রেষ্ঠ কবিতা বললে অত্যুক্তি হবে না। কিছু কিছু কবিতায় পাওয়া যাবে গ্রীক পৌরাণিক চরিত্রদের। আছে মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত কবিতা।

“কি বলে একাত্তর কিংবা পঁচাত্তর?

অন্তঃসত্ত্বা নারী, অবোধ শিশু

পিতার খুনে উল্লাসে মেতে ওঠে দুপেয়ে

পশুর দল।”

আছে রোমান্টিকতা, পূর্ণিমায় মুগ্ধ হওয়া, হরেক রকমের কষ্টের বর্ণনা, প্রজাপতির চুমু,  ধর্মের নাম ব্যবহার করে ভন্ডামির বর্ণনা।

পাঠককে মুগ্ধ করার জন্য অপেক্ষা করবে চমৎকার ৫টি বিদেশি কবিতার অনুবাদ। ৫ জন বিখ্যাত কবির কবিতার নিখুঁত বাংলা অনুবাদ।

“আমি কেউ না! তুমি কে?

তুমিও কি ‘কেউ না’

বেশ, তা হলে আমরা

হয়ে গেলাম এক জোড়া।”

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আছে হাইকু। মোট সাতাশটি হাইকু নিয়ে এই অংশ সাজানো হয়েছে।  হাইকু কবিতার ক্ষুদ্রতম অংশ হাইকু। হাইকু মূলত তিন লাইনের ছোট কবিতা। সপ্তদশ শতাব্দীতে জাপানে হাইকুর উদ্ভব। কবির প্রত্যাহিক জীবনের উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা, চোখে দেখা সৌন্দর্য তিন লাইনের এই কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন-

“শরতের মেঘ

শ্বেত ভল্লুক দিনের আলোয়

চুমু দেয় চাঁদে! ”

কিংবা

“শ্রাবণ সকাল

পশ্চিমে রংধনু

ভেজা কদম কেয়া”

৩য় অংশ সালতামামির পঙক্তিালা।  বাংলা বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ বৈশাখ হতে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞ থেকে প্রকৃতির রূপবৈচিত্র ছড়া ও কবিতায় ধারণ করা হয়েছে।

“বাংলা বছর জুড়ে ষড় ঋতুর যতো কথা

তারই বুনন ভরা পঙক্তিমালা”

কবি টিটো মুস্তাফিজের প্রথম প্রকাশিত কাব্য সালতামামির পঙক্তিমালা। বিষয়বস্তু,  ছন্দ ও শব্দ চয়নে অনন্য এ কাব্য গ্রন্থের বিন্যাসের দিকে আরও একটু সচেতন হলে কাব্যটি আরও সুখপাঠ্য হতো। এছাড়াও হাইকুগুলো কিছুটা দূর্বল ছিল। সব কিছু মিলিয়ে কাব্য গ্রন্থটি একটি সার্থক কাব্য।

“পদোন্নতি ঘটে কালে ভদ্রে

ফারাও এর পিরামিডে

কিংবা মহান গণতান্ত্রিক গ্রিসে,

দাস কিন্তু নাগরিক নয়।”

*রিভিউ লেখক- রুশিয়া জামান রত্না- সমাজসেবা অফিসার, মানিকগঞ্জ সদর। 

You cannot copy content of this page