মা- আরজু হকের গল্প
রক্তাক্ত ছোট বোনটাকে হাত ধরে ঘরে এনেছিল চান্দিবুবু। সাহস যুগিয়ে বলেছিল- ‘কান্দিস না। আমাগো কান্দন হুনবার কেউ নাই। তারচে’ আমার পথেই আয়া পড়। এ কামে খাটনি কম। মাইনষ্যের বাড়িতে খাইট্যা মরার চে’ এই ভালা।’
চান্দিবুবু ঐ গলির সদস্য। ওকেও নিয়ে যাবে বলেছে। বেশ কিছু টাকা লাগবে সরদারনীকে খুশি করতে। আর ছ’কুড়ি হলেই এক হাজার। এবার জমিলা ‘মিয়া বাজারের’ একজন হয়ে যাবে। রেল-পুলিশের তাড়া খেয়ে বেড়াতে হবে না আর। আপাতত আর ক’টাদিন এখানে কাটাতে পারলেই হয়। তারপরই মুক্তি!
নিজেই পিল নেয় জমিলা। কাস্টমাররা কষ্ট স্বীকার করতে চায় না। দু’বছর এ পথে কোন বিপত্তি ঘটেনি। তবুও কী করে যে কী হল! বিপদে পড়ল জমিলা। পোয়াতি হয়ে পড়েছে সে। কথা শুনে চান্দি বু হতবাক। -‘পোড়া কপালী! দোকানে কী পিলের অভাব পড়েছিল? কারে অমুন সব্বনাশ করবার দিলি?’
জমিলাও বুঝে গেছে নিজের সর্বনাশ। আর বুঝি ওপারে যাওয়া হল না। চান্দিবু চেষ্টা করল আপদটা দূর করতে। তখন বিলম্ব হয়ে গেছে। ‘জীবনের ঝুঁকি’ হবে বলে কোনো ডাক্তারও কাজটা করতে রাজী হয়নি। তারপর ডকের পরিত্যক্ত বগিতে ভূমিষ্ঠ হল গোলগাল ছেলেটি। কত সুখের কথা মনে পড়ল জমিলার। কার সাথে মিলে পোলাডার চেহারা? বেশ্যার পোলার আবার বাপ!
সন্ধ্যায় খাবার নিয়ে এসেছিল চান্দিবুবু। বলেছে, ‘অহন তো হইয়া গ্যাছে। ফালাইয়া দে গলা টিপ্পা ঝামেলাডারে।’ জমিলা বলছিল- ‘আইচ্ছা। তুইন মরা পোলাডারে ফালাইয়া দিয়াইস বুবু্’।
চান্দি সব ঠিকঠাক করে চলে যায়। শেষ রাতে আসবে। এই একমাস একদম আয় নাই জমিলার। সরদারনীর জন্য জমানো টাকা কয়টায় হাত দিতে হচ্ছে।
সন্ধ্যায় হওয়া বাচ্চাটা এখোনো কাঁদেনি। হয়ত বুঝে গেছে কাঁদলেই তার অনাহূত আগমন জেনে যাবে আশেপাশের মানুষ। দুঃসময়ে এই বাসগৃহ থেকে তাড়ানো হবে ওদের।
বাচ্চাটা নির্বাক চেয়ে আছে জমিলার মুখে। সন্ধ্যায় নাভী কেটে আলাদা হওয়া শত্রুটা তাকিয়ে কী দেখে? এর জন্যই ত স্বপ্নের গলিটা এখনো ওর দূরত্বে। এক্ষুনি মেরে ফেলা দরকার। কচি গলাটায় নেমে আসে জমিলার ‘মাছ মা’র হাত। হাত নামার সময় স্ফীত বুকে আঘাত লাগে। আরে ওখানে অমন টগবগ কিসের? কেমন এক অন্যরকম দপদপানি টের পায় জমিলা। স্তন জুড়ে দুধ এসে ভরে গেছে। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এসবই দুধের অত্যাচার। চমকিত হয় জমিলা। হাত পা ছোঁড়া শিশুটার একটা হাত এসে পড়ে তার বুকে। কী সোয়াস্তি! কী সোয়াস্তি! কত অত্যাচার সয়েছে এই বুক। কত পশুর হাতে দলিত হয়েছে বারবার। এই পুঁচকে শিশুর সামান্য হাতের স্পর্শের মতো তবু চমকিত হয়নি জমিলা কখনো।পাগলের মতো ব্যবহার করে বসে সে। বাচ্চাটার মাথা তুলে এনে মুখটা ছুঁইয়ে দেয় স্তনের বোঁটায়। চুক চুক শব্দে স্বর্গের শিশু টান দেয় নিজ অধিকারে।
মাঝরাতের আগেই জীবিত শিশু নিয়ে বেরিয়ে আসে জমিলা। চান্দি বু আসবে শেষ রাতে মরা বাচ্চা ফেলে দিতে নদীর পারে। জমিলাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নপুরীতে।
উদভ্রান্ত মেয়েটি এখন অন্য জমিলা। তার দুধাল স্তনে বাচ্চার মুখ। পথ চলতে পাগলের মতো প্রলাপ বকছে সে। -‘বাপ। তোরে কেডা মারব? আমি? না-না-না। আমি মারুম না। তুই আমার জান। দুনিয়ায় কেউ নাই তোরে মারতে পারে। তুই আমার আসমান ভরা তারা! আমি তোর নাম রাখুম…।’
স্টেশন ছেড়ে এসেছে জমিলা। আলোর ভয়ে অন্ধকারের দিকে দৌড়ায় ও। মনে পড়ে, ডকের পরিত্যক্ত বগিতে ফেলে এসেছে সরদারনীর জমানো টাকা। একটু থমকায় জমিলা। ঐ যে শেষ রাতের ট্রেন ঢুকছে স্টেশনে। এক্ষুনি এসে যাবে চান্দিবু!
অন্ধকার ভেঙে আরও অন্ধকারের দিকে ছুটতে থাকে নব-প্রসূতি মেয়েটি। এর মধ্যে স্তনের বোঁটা থেকে মুখ সরে যায় বাচ্চাটার। চিৎকার করে উঠে শিশুটি। প্রথম কান্নার শব্দ। ছুটতে ছুটতেই ক্লান্ত জমিলার ঠোঁট চুমোয় চুমোয় ভিজিয়ে দিতে থাকে শিশুটাকে। সন্ধ্যার শত্রুটাকে জড়িয়ে ধরে বুকের আরও গভীরে।
আরও পড়ুন- নাকফুল গল্প