মাটির টান- ললিতা রানী বর্মণ- গল্প

ছোট্ট একটা মেসেজ। আজ বিজয় দিবস। শুভ্রটা এতো কষ্ট দেয়! আজ বাংলাদেশের বিজয় দিবস। এই কথা ওর চেয়ে বেশি আর কার মনে থাকবে। ও ফেরত মেসেজ দিবে না। না তার কিছু লিখার নেই। শত ভাবনা ঘোরপাক খায় মাথায়। শুয়ে পড়েছিল তনুজা। পাশে স্বামী ঘুমে বিভোর। ওর ঘুম আসে না। এপাশ-ওপাশ করে সময় কাটে। ঘড়ির কাঁটা দু’টোর ঘরে। ও কাঁদবে না। কিছুতেই আর কাঁদবে না। ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রু। আঙুল দিয়ে চোখের কোল থেকে মুছে দেয় অশ্রু। বিছানা থেকে নেমে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। চতুর্দশী চাঁদ মধ্যগগন থেকে নেমে গেছে একটু পশ্চিমে। চাঁদকে দেখে নিজের কাছে যেন ধরা পড়ে গেল নিজস্ব একাকিত্ব। আজ অমাবস্যা হলে বুঝি ভালো হতো। আকাশ, বাতাস, সপ্তর্ষিমণ্ডলের কাছে নিজের একাকিত্ব ধরা পড়তো না। লুকিয়ে বেলকনিতে বসে কাঁদা যেতো। কিন্তু আজ যে সবাই হাসছে। এতো সুন্দর চাঁদের আলোয় মিশে যাবে তার চোখের জল! ঘরে এসে মেঝেতে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ে। এতো স্মৃতি, এক বুক স্মৃতি, ফেলে আসা স্মৃতি, এক বুক কষ্ট। অশ্রু ঝরে অবিরাম। টেবিল থেকে টেনে নেয় কাগজ কলম।

প্রিয় শুভ্রা,

আকাশের চাঁদ, একটাই চাঁদ, তুমিও দেখছো, আমিও। অথচ কত দূরে দু’জন, অনেক দূরত্ব, পাসপোর্ট ভিসার দূরত্ব। আজ ১৬ ডিসেম্বর। বলতে পার? দিন গুনি কিসের জন্য? তারিখের হিসেব রাখি কেন? ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারি যে আমার ঈদের দিন, পূজোর দিন তার আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে।

উপজেলার শিমুল গাছটা কেমন আছে? বৌলাইর শিমুলতলির নদীটা? আমাদের প্রিয় জায়গাটায় আর গিয়েছিলে? মহিলা কলেজের ঝড়ে উপরানো গাছটা কি কেটে ফেলেছে? গৌরাঙ্গবাজার ব্রিজের নিচের বরুণ গাছটা, রেল স্টেশনের পাকুড় গাছ, গুরুদয়ালের কৃষ্ণচূড়া, পুলিশলাইনের কদম, নতুন স্টেডিয়ামের বিপরীতে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, রেললাইন?

সামিয়া সিটি গোল্ড-এর লোকটা?

আমার স্বামী, খুব ভালো, আমাকে খুব ভালোবাসে। মাঝে মাঝে আমার কষ্ট তার কাছে প্রকাশিত হয়ে যায়। সে আমাকে সান্ত্বনা দেয়। সেদিন হঠাৎ যখন মনে হল আরও অনেক কিছুর মতো সামিয়ার লোকটাকেও আর দেখব না কোনোদিন। চোখের কোণে চিকচিক করে উঠে জল। ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। হয়তো তার মনে প্রশ্ন জাগে- সামিয়ার লোকটা কে? আমার প্রেমিক নয়তো? ও খুব উদার, ক্ষমা করতে জানে, বাস্তবতা বোঝে! ও আমাকে মনে মনে ক্ষমা করে। তার চোখ আমাকে বলে “মানুষের জীবেনে কত কিছু ঘটে সব মনে রাখতে নেই। তোমার ২৫ বছরের জীবনে কেউ আসতেই পারে, এতে আমি কিছু মনে করব না।” আমি বালিশে মুখ গুঁজি। ওকে বলি না, বলতে ইচ্ছে হয় না সামিয়ার লোকটার সাথে আমার যে সম্পর্ক তা মাটির সম্পর্ক, দেশের সম্পর্ক। তিনি হয়তো আমাকে চেনেনই না। আমার বলতে ইচ্ছে হয় ঐ লোকটা আমার জন্ম-জন্মান্তরের আপন- তোমার চেয়েও। সে আমার বাংলাদেশ, আমার ভাষা, আমার শহর, আমার শহরের থানা রোড।

রাস্তায় বিশাল কোনোও বটগাছ দেখে হয়তো আনমনা হয়ে যাই। আমার স্বামী, ও ভাবে হয়তো কোনোও পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেছে এবং সেখানে একটা ছেলে থাকতেই পারে। ও ডাকে “এসো এদিকে”। আমাকে ভালোবেসে আমার বুকের শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করে।

এ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গঙ্গা। আমি দেখি পাড়ে আছড়ে পড়ে ঢেউ, ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ঢেউয়ের তালে নৌকা দুলে। নিমিষে মন চলে যায় নরসুন্দার পাড়ে, কলাগাছের ভেলায় চড়ে শাপলা তুলি। মনের চোখ পড়ে পদ্মা ফেরীতে।

পদ্মার জল কি ঘোলাটে? সে দিন দেশ ছাড়ার সময় দেখলাম যে। কেমন ঘোলাটে। মাঝে মাঝে মনে হয় গঙ্গা আমার প্রিয় হতে পারে, পদ্মা আমার মা, নরসুন্দা আমার ভালোবাসা, আমার শীতল ছোঁয়া। নরসুন্দার জল আমার কাছে পিচগলা রোদে বৃষ্টির নিঃশ্বাস। আমার মনে হয় কি জানো, বাবা-মা-প্রিয়জন হারানোর ব্যথার চেয়ে সারাজীবনের মতো একটি গাছকে অথবা নদীকে হারানোর দুঃখ কোনো অংশে কম নয়।

শুধু দুঃখ নয়, সুখও আছে। যখন দেখি একটাই চাঁদ উঠে আকাশে, আমাকে সে চেনে, জানে আমি সেই মেয়েটি, যে পূর্ণিমা রাতে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতাম। গোধূলি বেলায় এখানে আকাশের ওপারে ডুবে যেতে যেতে আমাদের বাঁশবাগানের পেছনে ডুবে যাওয়া সেই সূর্যটাও আমাকে চেনে।

আজ ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস আমার দেশের। আনন্দ কষ্ট বুঝি না। আজ আমি বিদেশ বিভুঁইয়ে। হয়তো আর কোনোদিন যাওয়া হবে না সীমান্তের দাগ পেরিয়ে। ভালো থেকো। তোমার তনুজা।

আরও পড়ুন- ধাক্কা গল্প

You cannot copy content of this page