বন্যা- মিঠুন সরকার মিলনের গল্প
“ও… রতন…, রতন… রে…” হারামজাদা হেই কোন সময় বাইত গ্যাছে আর এহনো আইয়ে ন। বাইত গ্যালে পইড়্যা থায়ে, আইতো চায় না। ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ডেকে এভাবেই ছেলের উপর দুপুরের ক্লান্তিমাখা ক্ষোভ বর্ষণ করতে লাগল হারাধন। মনে মনে বলতে লাগল রতনকে জলের জন্য বাড়িতে পাঠিয়ে ভুলই করেছেন। তিনি নিজে যদি যেতেন তাহলে এই সময়ের মধ্যে চৌদ্দবার আসতে যেতে পারতেন। দুইজন হাতেহাতে কাজটা করলে তাড়াতাড়ি হয়ে যেত ।
খানিক পরে রতন জল নিয়ে ফিরলে, নিড়ানীতে বসা অবস্থাই হারবিন বললেন, “কি রে, এতক্ষণ কী করছত?’
‘জল লইয়া আওনের সময় মা’য় কইলো খাড়া, কোচ্ছাত কইর্যা তোর বাপের লাইগ্যা কয়ডা বড়ই লইয়া যা।’
‘বড়ই আনত?’
‘হ আনছি।’
“দে দুইডা বড়ই খাই, আর জলের জগড়া এমিহি দে।’
রতন বাবার হাতে বড়ই ও জলের জগ তুলে দিয়ে ধান গাছের গোড়ায় নিড়ানী দিতে দিতে বলে, “বাবা এই বছর ধান আইলে ধান বেইচ্চা আমারে একটা নতুন জামা কিন্না দিবা।’
‘হ দিমু, ভালা কইরা কাম কর। তুই ত খালি কামে ফাঁকি দ্যাছ্।’ ‘আমি আর কামে ফাঁকি দিমু না বাবা।’
সারাবেলা বাপ-বেটা ধান ক্ষেত আগাছা মুক্ত করে বাড়ি ফিরল।
আষাঢ় মাস। এই মাসটা আসলে ঘন বৃষ্টির বিরক্তির কথা মনে পড়ে হারাধনের। আবার আনন্দও লাগে। এই ঘন বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে গরম গরম খিচুরি খেতে কার মা ভালো লাগে। বৃষ্টি শুরু হল। পাঁচ-ছয় দিন চলে গেল। বন্ধ। এই বন্ধ তা তো আবার মুষলধারে নামে। মাঠে হাঁটু জল। ক্ষেতের আউস ধানগুলো ফুল নিয়ে অল্পদিনেই জলের নিচে ডুবে যাবে। বন্যা দেখা দিবে। দেশে আবার দুর্ভিক্ষ দেখা বেরিয়েছে। হারাধনের মাথায় চিন্তা ঢোকে। এভাবে বৃষ্টি নামতে থাকলে আবা দিবে। মানুষ পশুপাখি না খেয়ে মরবে।
ঠক, বৃষ্টির জল আর ভারতের পাহাড়ী ঢল নেমে মাঠ-ঘাট ডুবিয়ে সব একাকার। করে ফেলল। যেদিকে চোখ যায় বাড়িঘর ছাড়া শুধু অথৈ জল। কোনো কোনো ঘরেও জল উঠেছে। হারাধন ভাবতে থাকে এখন কী হবে? ক্ষেতের ফসল গুলিয়ে গেছে। ঘরে যে খোড়াকির ধান আছে তা দিয়ে তো বছর যাবে না। তখন কী হবে? রতনের মা জিজ্ঞেস করে, ‘আপনে এ্যামনে দুম ধইরা বইয়া থায়েন কিয়ারে? এত চিন্তা করনের কি আছে? হগলের যে দশা অয় আমাগোও হেই দশা অইব। হগলে মরলে আমরাও মরুম।
রতনের মায়ের এ সান্ত্বনায় কোনো ভরসা খুঁজে পায় না হারাধন। দুর্ভিক্ষের কথা চিন্তা করে খানা-দানা কমিয়ে দিয়েছে। আগে তিন বেলা খাইলেও এখন খায় দুইবেলা। তাও কম করে। রতনের মা বলে, ‘আপনে এত কম খান কিয়ারে? শাইলডার দিকে নজর দিছেননি। না খাইয়া খাইয়া শাইলডা ক্যামুন আড্ডিসার অইয়া গ্যাছে।
হারাধন ভাবতে থাকে গত বছরও তো আউস ধানের ভাত খাইছি, চিড়া খাইছি, বীছনের ধান রাইখা কিছু বিক্রিও করছি। আবার আমন ধানও গোলায় উঠাইছি হেই ধানই এখনো ভরসা। এ বছরটারে কোন অকালে পাইল। দিন যায়, জল কমে, বন্যা শেষ হয়। হারাধন নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
আরও পড়ুন- এখন অভিশপ্ত বাড়ি গল্প