নাকফুল- আজহারুল হকের গল্প

নাকফুল- আজহারুল হকের গল্প short stories in bengali গল্প কার্টুন, শিক্ষনীয় গল্প, হাসির গল্প, বাংলা গল্প, মিথ্যে ভালোবাসার গল্প

টিনের বাক্সটা যখন খুলে দেখছিল সবাই, খুব আশাহত হয়েছিল করিমন। বিয়েতে অন্তত একটা সোনার নাকফুল সে আশা করেছিল। নিজের রুপগুণের বড়াই করে না করিমন। সে অসুন্দর। কালো। তো কী হয়েছে? ইচ্ছে তো আর যোগ্যতা অযোগ্যতা দিয়ে বশ করা যায় না। নাকফুলের কষ্টটা বুকের মধ্যে চাপা দিয়েই স্বামী বাবুলের ঘরে গেল করিমন।

বাবুলের শূন্য ভিটায় কতকাল পর চুলা ধরল। ভাত বেড়ে খাওয়াল একজন মানুষ। তালপাখার বাতাস দিল শরীরে। রাতে বউয়ের হাত দু’টি ধরে কত কী যে বলতে চাইল বাবুল!

‘বউরে, ম্যালা দিন বাদে গরম ভাত খাইলাম। কেউ বাইড়া খাওয়াবে অমন ভাগ্য আমার হইব, ভাবী নাই। তুমি আমার ঘরটা ভইরা দিছ বউ! তুমারে যে কই রাখি, কী দিয়া যত্ন করি আমার জানা নাই। তুমি আমার বুকের মধ্যে থাইকো। সারা জীবন বুকের মধ্যে থাইকো।’

চোখ ভরে পানি এসে যায় করিমনের। আবেগে কেঁপে উঠে সে। তারপর গভীর মমতায় একসময় বাবুলের ছোট্ট সংসারে দক্ষ গিন্নি হয়ে উঠতে থাকে। নাকুফুলের কষ্টটা ভুলে লাউ, সীমের বীজ বোনে উঠোনে। মুষ্টির চাল জমায়। পোষা হাঁস মুরগির ডিম বেঁচে টাকা জমায়।

বাবুল কিন্তু নাকফুলের কথাটা ভুলে একদম! আর কিছু টাকা পয়সা জমলেই জেওরটা কিনে দেবে সে করিমনকে। এর মধ্যে গঞ্জের দোকানে যেয়ে ছোট্ট একটা নাকফুল দাম করে এসেছে সে। আটশ’ টাকা লাগবে। মাঝে মাঝে গঞ্জেও রিক্সা চালাতে যায় বাবুল। জেওরের টাকাটা জোগাড় করা খুব দরকার।

ঐদিন নিজের জমানো টাকায় বাবুলের জন্য একটা নতুন তহবন কিনে ফেলল করিমন। রাতে তহবনটা বাবুলের হাতে দিতে দিতে বলে-

-‘এক বছরে আপনার সংসার থেইক্যা যা জামাইছি, তা দিয়া কিনলাম, দেহেন তো পছন্দ হয় নাকি?’

অবাক হয়ে বউয়ের মুখে দিকে তাকায় বাবুল।

রোজগার বাড়াতে থাকে। আজ ক’দিন হল ঢাকায় রিক্সা চালাচ্ছে বাবুল। গঞ্জের থেকে আয় বেড়েছে অনেক। আর কিছুদিন এখানে রিক্সা চালাতে পারলে একটা কেন, দুইটা নাকফুলের টাকা জোগাড় হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

বউয়ের জন্য, বাড়ির জন্য মনটা কেমন কেমন করে। সাহস করে নয়শ’ টাকায় ছোট্ট একটা নাকফুল কিনে ফেলে সে। আর মন টিকে না ঢাকায়। ভোরের ট্রেনেই ফিরে আসে বাবুল বাড়িতে।

বউয়ের নাকে নাকফুলটা পড়িয়ে বীরের মতো তাকিয়ে থাকে বাবুল।করিমন অবাক! নাকফুলের কষ্টটা যে এখনো বেঁচে ছিল তার উচ্ছাস দেখেই বুঝা যায়। করিমন পাঁচ-দশবার করে আয়নায় দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে জেওরটা। আনন্দের মৌমাছি গুনগুন করে উঠে মনে।

কয়দিন না যেতেই নাকফুলটার রং ময়লা হয়ে যেতে লাগল। করিমনের কেমন জানি সন্দেহ হল। নকল সোনা না তো?

ঠিক হল কালকেই গঞ্জের জহুরী কাকার দোকানে নিয়ে যাবে। জেওরটায় কোনো ভেজাল আছে কিনা দেখা দরকার!

করিমন কুমড়োর বড়া ভাজে। খিচুরি পাকায়। লেপা ঘরটায় হোগলার মাদুর বিছিয়ে রাখে।

জহুরী কাকার কথার মাথায় বাজ পড়ে বাবুলের। জেওরটায় একফোঁটা সোনা নাই। পিতলের। রং দিয়ে চকচকা করা ছিল। বাবুলকে ঠকিয়েছে ঢাকার দোকানি।

কথাটা কেমন করে বলবে সে করিমনকে! ইচ্ছে করল উড়ে যেয়ে ঢাকার দোকানির মাথায় একটা বাড়ি দিতে। দোকানি কি বিশ্বাস করবে বাবুলের কথা? রসিদ না কী বলে তাইত নেয় নাই সে ওখান থেকে।

আনমনা বিষণ্ণ বাবুল উঠানে দাঁড়ালে করিমন বদনায় পানি এগিয়ে দেয়। -‘কী হইছে? মুখটা অমন কালা কেন? হাতমুখ ধুইয়া আসেন, খাইবেন।’

বদনার পানি ঢালতে ভুলে যায় বাবুল। কথাটা সে কী করে বলবে বউকে?- ‘কী হইল? জহুরী কাকা কী কইলেন? সোনা কি নকল?’

দ্রত বদনার পানি ঢালা শুরু করে বাবুল। ঝপাঝপ পানি ছিটায় মুখে। থালাটায় ঘ্রাণ ছড়ানো খিচুরির একপাশে অনেকগুলো কুমড়োর বড়া সাজিয়ে দিয়েছে বউ। করিমনের কিনে দেয়া তহবনটার কোঁচড় থেকে নকল নাকফুলটা বের করে বাবুল। বউয়ের বাড়ানো হাতে দিয়ে বলে-

‘সোনা ঠিকই আছে। জহুরী কাকা কইছে, কোনো ভেজাল নাই।’ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে করিমনের চোখ। নাকফুলটা দ্রুত পড়ে নেয় সে। তাই ত, অত্ত টাকায় কেনা জেওরটা নকল হয় কেমনে?

বাবুল দেখে বউয়ের মুখটা প্রথম দিনের নাকফুলের চেয়ে বেশি ত্যাজে জ্বলজ্বল করছে। একপশলা শান্তির বৃষ্টি নামে তার বুকে। পরক্ষণেই চৈত্রের খরা এসে ফেটে চৌচির করে দিয়ে যায় ভেতরটা। সুস্বাদু খিচুরিটা কেমন লাগতে থাকে। কামড় দেয়া কাঁচা লংকাটায় মনে হচ্ছে এক ফোঁটা ঝাল নাই।

আরও পড়ুন- রওশন আরা লীনার গল্প