ধাক্কা- রওশন আরা লীনার গল্প

যৌবনে পদার্পণ করিয়াই সাদেক আলী এক বিষম ধাক্কা খাইলেন। ইহা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিনি যদি কঠিন কোনো বস্তুর সঙ্গেও ধাক্কাটা খাইতেন তবে হয়তো হাত পা ভাঙিয়া অবশেষে বাঁচিয়া যাইতেন। কিন্তু যাহার সঙ্গে তিনি ধাক্কা খাইলেন তাহা জগতের সবচেয়ে কঠিন অথচ নিতান্তই বায়বীয় একটি পদার্থ, মন। সুতরাং লজিংমাস্টার সাদেক আলী একূল ওকূল দুই কূলই হারাইলেন। তাহাতে অবশ্য সাদেক আলীকে দুঃখিত মনে হইল না। বরং নবানন্দে ছাত্রী কাম প্রেয়সীকে লইয়া আকূল পাথারে ভেলা ভাসাইতে প্রস্তত হইলেন। কার্যত এখানেই বিপত্তি বাঁধিল, যাহাকে লইয়া তিনি এই দুরুহ কার্যে ব্রতী হইয়াছিলেন, দেখা গেল সে কন্যারত্নটি এত নির্বোধ নহে। তাহারও রসরোধ আছে। শিক্ষকের সঙ্গে কিছুদিন ফষ্টিনষ্টি করিয়া মাস্টারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ আনিয়া অকূল পাথারে নয় ব্যাংকেফিক্সড ডিপোজিট করিবার মতোই এক বড়লোকের গলায় মালা পরাইয়া সে নিশ্চিন্ত হইল।

বলাই বাহুল্য সাদেক আলী বড়ই চোট পাইলেন অন্তরে। অতঃপর বহু বিনিদ্র রজনী পার করিয়া বহুঘাট ঘুরিয়া অবশেষে এক ধনী পিতার একমাত্র কন্যারত্নকে বিবাহ করিয়া স্থির হইলেন। বিবাহের সময় কন্যা সুন্দরী কিনা কিংবা পূর্বে বিবাহ হইয়াছিল কিনা ইহা লইয়া তিনি আর ভাবিয়া দেখেন নাই। কারণ ততোদিনে তিনিও বুঝিয়াছেন সকল ধাক্কা সামলাইবার একমাত্র পথ হইল অর্থ। যাই হোক এই সকল পুরোনো কথা। আমাদের সাদেক আলী লজিং মাস্টার হইতে এখন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সাদাকালো নানান পথে তিনি যা উপার্জন করিয়াছেন তাহাতে তাহার তিনপুরুষ নিশ্চিন্তে বসিয়া খাইতে পারিবে। অতীতের দিনগুলো তাহার কাছে এখন কষ্ট-কল্পনা মাত্র। সুতরাং বলা যায় তিনি সুখী। কিন্তু সমস্যা এখানেই যে, সাদেক আলীর মনে সুখ নাই। কারণ প্রথ যৌবনে পাওয়া চোট আজও তিনি ভুলিতে পারেন নাই। তাহার মতে তাহার মতো সৃজনশীল পুরুষকে টাকা হয়তো মাথার টাক দান করিয়াছে কিন্তু মনটাকে তো আর মরুভূমি করিয়া দেয় নাই। সুতরাং তিনি আবারও এক প্রস্থ ধাক্কা খাইলেন। হাতে টাকা থাকিলে বেশির ভাগ মানুষেরই একটু সমাজসেবা করিবার বাতিক চাপে। সাদেক আলীও এর ব্যতিক্রম নন। একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান খুলিয়া নিজেই ইহার কর্ণধার হইয়া বসিলেন এবং নিয়মমতো একজন পার্সোনাল সেক্রেটারি রাখিলেন।

পঁয়তাল্লিশ উর্ধ্ব সাদেক আলীর অবরুদ্ধ প্রেম অবশেষে ইহার উপরই বড় কোমলভাবে বর্ষিত হইল। কখনো কখনো দেন দরবার আবার কখনো ভুল-ভাল কবিতায় প্রতিনিয়ত আপনার মনোবিকাশ তিনি করিতে লাগিলেন। সেক্রটারি মেয়েটি প্রথমে প্রথমে হাসি চাপিল এবং অবাক হইয়া বসের আচরণ পর্যবেক্ষণ করিতে থাকিল। চাকুরি বাঁচাইবার তাগিদে ‘না’ বলিতে তাহার সাহস হইল না এবং সাদেক আলীও হাল ছাড়িলেন না। ভুল ভাষায় শরৎকে রবীন্দ্র অথবা নজরুলকে জীবনানন্দ করিয়া চেষ্টা অব্যাহত রাখিলেন। তিনি জানিতেন ও সকল ভাষা সাহিত্যেই খেলে ভালো। মেয়েটি শেষে আত্মসমর্পণ করিয়াছিল কিনা জানি না। তবে বেশ দেখিতে পাইতাম সাদেক আলীর টাক আরও চকচকে হইয়াছে, গায়ে চড়িয়াছে রংচঙে শার্ট।

বিগলিত হাসিতে দু’জনকেই মাঝেমাঝে এইখানে ওইখানে যাইতে দেখা যাইত। কিন্তু সুখ কারো কপালে বেশিদিন সয় না ইহা স্বীকার করিতেই হইবে। নইলে ইহা ঘটিবে কেন? প্রথম জীবনের ব্যর্থতার পরে নাদেক আলী অনেক কষ্টে দুইটি জিনিস করিতে শিখিয়াছিলেন- এক অর্থ উপার্জন ও দুই সংরক্ষণ। প্রাণে ধরিয়া একটি টাকাও তিনি খরচ করিতে চাইতেন না। যদিও বান্ধবীর পেছনে বেশ খরচ হইতেছে এবং ইহা লইয়া তাহার দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না। এমন সময় ব্যবসার বড় একটি কন্ট্রাক বাগাতে গিয়া সাদেক আলী বিপত্তির মুখে পড়িলেন। এটাতে অর্থের ও মাংসের দুটোরই দরকার ছিল। প্রথমটি সাদেক আলী খরচ করিলেন। কিন্তু সজীব মাংসপিণ্ডের প্রয়োজনে আর বাড়তি ধাক্কা সহিতে চাহিলেন না। তিনি আপনার অর্জনের মাঝেই হাত বাড়াইলেন। প্রেমিকাকে বুঝাইলেন প্রেমাস্পদের জন্য এতবড় আত্মত্যাগ কে কবে করিয়াছে।

লাইলী মজনু। শিরি ফরহাদের প্রেমও তার কাছে তুচ্ছ। কারণ তাহারা শুধু কাঁদিয়াই মরিয়াছে, দিতে পারে নাই কিছুই। এ প্রস্তাবের সমস্যা কোথায় ছিল সাদেক আলী তাহা বুঝিলেন না, তাহার প্রেয়সীও বুঝিতে চাহিল না; শুধু একটা ইতর ছোটলোক দিয়া সাদেককে আবার দরিয়ায় ভাসাইয়া কোথায় যে অন্তর্নিহিত হইল সাদেত আলী- তাহার আর কোনোও সন্ধান পাইলেন না। ব্যবসা, প্রেম নিয়া সাদেক আলী যখন এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাবে হাবুডুবু খাইতেছেন অকূল পাথারে, মোবাইলে তখনই তাহার স্ত্রী ফোন করিলেন, বাড়িতে যৌথ বাহিনীর শুভাগমন ঘটিয়াছে, বাড়ি সার্চ হইতেছে সাদেক আলী আর পারিলেন না। জীবন যৌবনের এই নানাবিধ টানাপোড়েনে শেষোক্ত ধাক্কায় একেবারে ভূমিশয্যা গ্রহণ করিলেন।

আরও পড়ুন-  মা গল্প

You cannot copy content of this page