টিটো মোস্তাফিজ এর হাইকু অভিযাত্রা – বই রিভিউ- রুশিয়া জামান রত্না

গ্রন্থের নাম: হাইকু অভিযাত্রা

গ্রন্থের ধরণ: অনুকাব্য

 রচয়িতা: টিটো মুস্তাফিজ

প্রকাশনা  প্রতিষ্ঠান: রচয়িতা, উত্তরা, ঢাকা

প্রথম প্রকাশ মার্চ: ২০২১

প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: টিটো  মুস্তাফিজ

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১২

মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা

 

কবি পরিচিতি: 

লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে নিরবে নিভৃতে সাহিত্যপ্রেমে নিমগ্ন হয়ে আপন খেয়ালে নিজেকে সাহিত্য চর্চায়  নিয়োজিত রাখতে যারা স্বাচ্ছন্দবোধ করেন  তাদেরই একজন কবি টিটো মোস্তাফিজ। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের সেই গানের পাখি যে আপন মনে দিগ্বিদিক গান গেয়ে বেড়ায়, আপন খেয়ালে গানের সুর তোলে।  সে সুর  কখনো  শান্ত নদীর মত মৃদু ছন্দে বহে,  কখনো বর্ষায় পাড় ভাঙ্গা শব্দের মত,  কখনো শব্দমালা জুড়ে  স্বচ্ছ পানির ঢেউয়ে জোছনার  কাঁপন,  কখনো বা নিজের মনে গুমোট বাধা রাগ ক্ষোভ ঘৃণাঘৃণার বহিঃপ্রকাশ যা ব্যঙ্গ বিদ্রূপ  আর কটাক্ষের গাথুনিতে প্রকাণ্ড দেয়াল তৈরি করে। কবি টিটো মোস্তাফিজ বাংলায় হাইকু লেখার পাশাপাশি ইংরেজিতেও হাইকু লিখে থাকেন। দেশি বিদেশি বহু ম্যাগাজিনে তার হাইকু প্রকাশিত হচ্ছে। বিশেষ করে Allpoetry–তে তাঁর লেখা হাইকুসমূহ বহুল পঠিত ও সমাদৃত। দেশ এবং দেশের বাইরের অগণিত পাঠকের ভালোবাসা তার হাইকু লেখার অন্যতম অনুপ্রেরণা।

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর নাটোর জেলার  বাগাতিপাড়া উপজেলার মারিয়া গ্রামে সমকালীন সাহিত্যের এই নিভৃতচারী কবির জন্ম। রাজশাহী  ক্যাডেট কলেজ থেকে  পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। রসায়ন এর সাথে কবি মনের আদান প্রদান সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও সাহিত্যে শব্দের রসায়ন তৈরিতে তিনি বরাবরই সিদ্ধহস্ত।

রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম, গ্রীক পুরাণ, মির্জা গালিব, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত  ভট্টাচার্যসহ অনেক কবি সাহিত্যিকদের প্রতি অনুরাগ থাকলেও জাপানি হাইকু মাস্টার মাসাওকা শিকি তার  লেখার বিশেষ করে হাইকু লেখার মূল অনুপ্রেরণা।

হাইকু এক ধরনের জাপানি কবিতা।  কবিতার ক্ষুদ্রতম রূপ হচ্ছে হাইকু। লেখক টিটো মোস্তাফিজ হাইকু কে নিজের উপজীব্য করে সাহিত্যচর্চা করে যাচ্ছেন।  বাংলাদেশে হাইকুকে জনপ্রিয় করার জন্য তিনি নিরন্তন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে তার বেশ কয়েকটি হাইকু প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম সালতামামি পংক্তিমালা। এ কাব্যগ্রন্থে তিনি প্রথমবারের মতো সাতাশটি হাইকু প্রকাশ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হাইকু হলো:

  “পাইনি বলে

তুমি আজও আফ্রোদিতি

অনন্ত যৌবনা! “

“জ্যোৎস্নারাত

আকাশ ভরা শূন্যতা

চাঁদের মনোপলি “

“পহেলা বৈশাখ

ঐতিহ্য ভেসে চলে

সৌখিন পান্তায়”

হাইকুকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য কবি টিটো মোস্তাফিজ সম্পন্ন করেছেন “হাইকু গ্রাজুয়েশন কোর্স”। হাইকুকে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় করার জন্য তিনি নিয়মিত হাইকু লিখে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ২০২১ সালে প্রকাশ করেন তার প্রথম হাইকু নিয়ে লেখা গ্রন্থ “হাইকু অভিযাত্রা”।

হাইকু অভিযাত্রা গ্রন্থ সমালোচনা:

 বর্তমান যান্ত্রিক জীবনের যাঁতাকলে পিষ্ট প্রতিযোগিতাময়  জীবনে দাঁড়াবার ফুরসত মেলা ভার। পৃথিবীর গতিকে হার মানিয়ে ঘুরতে গিয়ে ঘুরপাক খেয়ে ঘূর্ণায়মান আমাদের চিন্তা চেতনা একেবারে অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবনের ব্যস্ততা যেমন বেড়েছে তেমনি কমেছে সাহিত্য চর্চার সময়। যুগের দাবিতেই তাই সাহিত্য এসে রুপ নিয়েছে অণুর পর্যায়ে। যেমন- অনুকাব্য,  অনুগল্প ইত্যাদি। অনুকাব্য শাখায় হাইকু একটি জনপ্রিয় রুপ। মাত্র তিন লাইনের কবিতায় মানুষ খুঁজে নেয় নিহিত অর্থ। ঠিক যেন, বদ্ধ ঘরের গুমোট গরম বাতাসের ভেতর ছোট্ট ভ্যানটেলেটরে আসা কিছুটা শীতল হাওয়ার স্পর্শ।  গতিময় জীবনে একটু থেমে সাহিত্যের আনন্দ উপভোগ করে আবার ছুটে চলা।

“হাইকু অভিযাত্রা” মূলত দুটি অংশে বিভক্ত।

ক) প্রথম অংশে আছে “প্রাককথন আমার ও হাইকুর কথা

খ) দ্বিতীয় অংশে আছে ৩১২টি হাইকু।

প্রথম অংশে কবি হাইকু নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন যা কবির একান্ত গবেষণালবদ্ধ তথ্য। কবি নিজে জাপানি গিয়েছিলেন সরকারি কাজে। সেখানে গিয়ে হাইকুর প্রতি আকৃষ্ট হোন। দেশে ফিরে হাইকু নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।  বিভিন্ন বই, ম্যাগাজিন এবং ইন্টারনেটে তথ্য নিয়ে সমৃদ্ধ করেন নিজেকে। মূলত এই অংশে হাইকুর উদ্ভব,ইতিহাস, লেখার নিয়ম কানুনসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছেন।

২য় অংশে আছে ৩১২টি হাইকু। এই ৩১২টি হাইকুকে আবার  ৯টি পর্বে ধরন অনুযায়ী সাজিয়েছেন।  তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

বিভিন্ন ঋতু নিয়ে লেখা হাইকু–

 “হট্টিটি জীবন

পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ে

কমে সম্পর্কের তাপ

   শরতের মেঘ দূত

কোথা যাবি নিয়ে চল

যাযাবর মন

 নাগরিক জীবন নিয়ে লেখা।  যেমন-

নাগরিক জীবন

কনক্রিটের খাঁচার মাঝে

একফালি আকাশ

ঘুমন্ত মহানগর

বেওয়ারিশ কুকুর আর

নিয়ন বাতির আলাপ”

অনলাইন জীবন নিয়েও লিখেছেন হাইকু। যেমন–

“হাজারো বন্ধু

উদ্বায়ী অর্জনে ছোটে

একাকী মানুষ”

এছাড়াও লিখেছেন গুণিজন, প্রকৃতি,  নব্য সাম্প্রতিকসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।

মূলত, কবি তার তৃতীয় নয়নে যেটাই অনুভব করেছেন তা তার কলমের সাহায্যে হাইকুতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তার হাইকুতে খুঁজে পাওয়া যায় না পাওয়ার হাহাকার, নগর জীবনের ব্যস্ততা, অনুভূতি হারানোর বেদনা কিংবা প্রচন্ড ক্ষোভে বিদ্রুপ করা সমাজকে। মুখোশের পরে মুখোশ দেখে কবি ব্যক্ত করেছেন হতাশা। সমকালীন অন্যায় অত্যাচার কবিকে ব্যথিত করে আবার বিদ্রোহী মন মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করতে চায়।

 “রোহিঙ্গা ক্যাম্প

ভারী হয়ে নেমে আসে

দুর্যোগের মেঘ।”

কবির কবিতা পড়ে সচেতন পাঠক মাত্রই কবির চিন্তা চেতনা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। শুধু বিদ্রোহী নন।  কবি-র আছে ভালোবাসা ভরা একটি হৃদয়।  তিনি প্রেমের প্রতি অনুরাগীও বটে।

 “ভালোবাসি তোমায়

দূরে থাকা নিরাপদ এখন

আগামীর প্রত্যাশায়।”

 “প্রিয় কত ইচ্ছে!

বনসাই করে রাখা হয়

প্রতিনিয়ত। “

ব্যস্ততম সময়ের মধ্যেও যারা প্রশান্তি  খুঁজে পেতে একটু সময় বের করে সাহিত্যে নিজেকে সঁপে দিতে চান তাদের জন্য “হাইকু অভিযাত্রা” দারুণ সহায়ক হবে বলে বিশ্বাস করি।

 বইয়ের রেটিং: ৪/৫

 রিভিউ লেখক- রুশিয়া জামান রত্না, সমাজসেবা অফিসার।

You cannot copy content of this page