কবিতার আলোচনা: সাইফুদ্দিন সাইফুলের কবিতায় মানুষ এবং পৃথিবী

মধ্যযুগের কবি বড়ু চন্ডিদাস দাস উচ্চারণ করেছিলেন মানব মুক্তির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বাণী-

“সবার উপরে মানুষ সত্য,

তাহার উপরে নাই”

এই পৃথিবী মানুষের জন্য। মানুষ আছে বলে পৃথিবী আছে। আছে নানা  আইন- কানুন, নানা প্রতিষ্ঠান।  মানুষ না থাকলে পৃথিবী কোন প্রয়োজন হতো না। প্রয়োজন হতো না কোন আইন–কানুন, প্রতিষ্ঠান। মানুস আছে তাই পৃথিবীর  প্রয়োজন। প্রয়োজন আইন-কানুন, প্রতিষ্ঠান। মানুষ আছে আইন আছে, আছে যত সব প্রতিষ্ঠান। বনে পশু বসবাস করে, সেখানে কোন আইন, প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন হয় না। সংগত কারণে সেখানে আইন, প্রতিষ্ঠান অপ্রয়োজন। যেখানে মানবতা লঙ্ঘিত হয়, সেখানে কোন কিছু থাকতে পারে না। সুতরাং আমরা যা কিছু করি না কেন- আইন আদালত প্রতিষ্ঠান, ধর্ম -কর্ম, সব কিছু হতে হবে মানুষের কল্যাণের জন্য। মানুষ কোন ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। এই পৃথিবীটা হচ্ছে মানুষের। আমরা একই পৃথিবীতে বাস করি । একটি মাত্র আকাশের নিচে জীবন যাপন করি। জাত-পাতহীন গোটা পৃথিবীটাই মানুষের। সেই সুরে সুর রেখে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে কবি সাইফুদ্দিন সাইফুল মানুষ হবার ঘোষণা দিয়েছেন এইভাবে-

“আমি পৃথিবীর নাগরিক!

আমি দুপায়ে দলেছি উঁচু নিচু যতো জাত,

মানুষ এই আমার পরিচয়

যাপিত জীবনে ভুলেছি মিথ্যে জাত-পাত।”

(আমি পৃথিবীর নাগরিক: নীলাম্বর)

আজ চারিদিকে মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। ইট পাথরের এই যান্ত্রিক সভ্যতার উৎকর্ষে মানুষের বিবেক হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ আজ বড় বেশি যান্ত্রি। ক্রমেই এই মানুষের শহর নগর পৃথিবী বসবাসের অপযোগী হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর দিকে দিকে পূর্বেও মানুষ শোষিত- নির্যাতিত হতো বর্তমানে তা আরো ভয়ংকার আকারে বিস্তৃত হচ্ছে। এমন কি কোথাও কোথাও যা চরম সীমা অতিক্রম করেছে। পারমানবিক এই যান্ত্রিক সভ্যতার এই যুগে যা গোটা পৃথিবীর জন্য ভয়ংকার হুমকিজনক। এমন কি ধ্বংসও করে দিতে পারে দীর্ঘ পরিকল্পনা প্রমে গড়া পৃথিবী। সাম্প্রতিক চলমান কোভিড-১৯ আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে সমগ্র পৃথিবী আজ কাঁপছে। যা কারোর একার সমস্যা নয়।পৃথিবী আজ বসবাসের জন্য হুমকি স্বরূপ। ক্রমেই তা আরও ভয়াবহ হচ্ছে। আমাদের আগামী প্রজম্মও হুমকির সম্মুখিন। বিবেক বর্জিত এই সভ্যতা। এই সমস্যা থেকে উত্তোরণ করতে হবে। পৃথিবীটাকে বসবাস যোগ্য করতে হবে। কবি সুকান্ত  ভট্টাচার্য যেমন বলেছেন “এ বিশ্বকে এ- শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার ।” (ছাড়পত্র: সুকান্ত ভট্টাচার্য)

কবি সাইফুদ্দিন সাইফুল তার কবিতায় সেই অমানবিক দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন রূপকের আড়ালে। তিনি লিখেছেন “পাখিরা শহরে অলীতে গলিতে রক্ত দেখে ভীষণ অবাক হয়/অবলা পশুদের না মানুষের রক্ত ভেবে মনে লাগে ভয়।/*/প্রেমহীন নিথর শহর ছেঢ়ে পাখিরা বনে ফিরে চলে/এই শহর মানুষের না রাক্ষদের কেঁদে কেঁদে বলে।”-(বনের পশুরা এলো মানুষের শহরে: নীলাম্বর)

পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী। একদিন মানুষ নশ্বর দেহ মাটিতে বিলীন হবে। এই ধরাধামে কেউ চিরকাল থাকবে না। তবু মানুষের হুস হয় না। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর এই ক্ষণ জীবনের জন্য ক্ষমতা- শক্তির অর্থ অপব্যবহার করছে। মানুষ বধের জন্য অনৈতিক প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এই  চিরন্তন সত্য কথা গুলো মানুস ভুলে যায়।কিন্ত আমাদের ভুললে চলবে না আমারা চিরদিন এই পৃথিবীতে থাকব না। মানুষের এই পৃথিবীতে মানুষকে অবহেলা অত্যাচার করা যাবে না। মানুষ শ্রেষ্ঠ জেনেই মানুষের আরাধনা করতে হবে। মানুষের আরাধনা ব্যতীত- সব শুভঙ্করের ফাঁকি- ধোঁকা দেওয়া ছাড়া  কিছুই না। মানুষকে শ্রেষ্ঠ জেনেই মানুষের কল্যাণে কাজ করার এই আহ্বান করেছেন কবি সাইফুদ্দিন সাইফুল “এতোটুকু ক্ষমতা পেয়ে আমরা হয়ে যাই বড্ড বেসামাল,/ভুলে যায় আপন পরিচয় থাকে না কোনো হিতাহিত তাল/ জীবাত্বারূপে পরমাত্বার সন্ধান করো জগৎ সংসারে, /নইলে জীবনে রঙ্গসাঙ্গ হবে ডুবে যাবে গহীন অন্ধকারে…” (নূহের নৌকায় ভেসে চলেছি: নীলাম্বর)

একটা পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে রাঙা সকাল। একটা পরিবর্তন গোটা পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারে। একটা  ভাল পথই পারে আলোর পথ দেখাতে। মানুষের  নিজের পরিবর্তন করতে হবে। আলোর পথে নিজেকে পরিচালিত করতে হবে। শুধু মাত্র নিজে পরিবর্তন হলে জগত পরিবর্তন হবে। মানুষের এই পৃথিবী মানুষের পরিবর্তন হতে হবে। একটি পরিবর্তন পারে জগতের জন্য কর‌্যান কর‌্যঠু করতে।সুতরাং যে যেখানে আছি সেখান থেকে আমাদের পরিবর্তন হতে হবে। একটি সত্যিকার মানুষের পৃথিবীর জন্য কবি সাইফুদ্দিন সাইফুল আমাদের মননের পরিবর্তন প্রত্যাশা করেছেন। আসুন আমরা পরিবর্তন হয়। নিজেকে নিয়োজিত করি মানুষের কল্যাণে। তিনি লিখেছেন “নব-প্রত্যয়ে নব চেতনায় রঙে রাঙিয়ে মন,/পরিবর্তনের আালোতে আলোকিত হোক ক্ষণজীবন”  (পরিবর্তনই আলো নিয়ে আসে: নীলাম্বর)

মানুষের ভাল  না বাসলে, মানুষের প্রেম না করলে মুক্তি মেলে না। মানুষকে ভালবাসতে হবে, মানুষকে শ্রদ্ধা করতে হবে। কিন্তু  মানুষ জাতের বড়াই করে ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি করে। মানুষের সেবাই হচ্ছে ধর্ম। মানুষকে যারা সেবা করে না তারা কোনো ধর্ম মানে না। মানুষের সেবা করলেই ধার্মিক হওয়া যাবে। যারা মানুষের সেবা করে না তারা কোনো ধর্ম মানে না। ইসলাম ধর্মে  জনস্রোত আছে মানুষ সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ তাঁর ভেতরে রুহু ফুঁকে দিয়ে ফেরেসতাদের মানুষকে(আদম)সিজদা করতে বলে। উল্লেখ্য আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ইসলামে সিজদা করার নিয়ম নেই এবং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।তৎকালীন ফেরেস্তাদেন সর্দার মানুষকে সিজদা না করে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে ।

মানুষকে সিজদা না করার কারণে ফেরস্তাদের সর্দার হয়েও হয়ে গেলেন শয়তান।  বর্তমান সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে মানুষ নিজেদের স্বার্থে জাত, দেশ পরিসীমা সৃষ্টি করে মানুষ হত্যা করছে। মানুষের অত্যাচার করছে। মানবতা লঙ্ঘন করে স্বর্গ লাভের আশা করা বোকামী ছাড়া আর কিছুই না। তারা মানুষের শত্রু। পৃথিবীর শত্রু। সৎ কর্ম করতে হবে। কর্মে মানুষের পরিচয় মেলে। কর্মই ধর্ম। অকর্ম করলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। মানুষ সেবাই আমাদের মুক্তি। এই রকম কঠিন সত্যকে আরও দৃঢ়ভাবে বলেছেন কবি সাইফুদ্দিন সাইফুল। তিনি লিখেছেন “যে বিশ্বাস তোমার মনে/ সে বিশ্বাস অটল থেকো/ সত্য মানলে মানবের তরে/ প্রেম ভক্তি শ্রদ্ধা রেখো।/ */জাত ধর্ম নিয়ে হানাহানি/ নিষেধ আছে শাস্ত্রে ধর্মে, / যতোই করো বাড়াবাড়ি/ হবে মুক্তি সৎ কর্মে।” (আমার বিশ্বাস আমার আছে: নীলাম্বর)

মানুষ চিরকাল মুক্তি চেয়েছে। মুক্তির জন্য সমাজ বদ্ধ হয়েছে। গঠন করেছেন পরিবার সমাজ গোত্র। মুক্তির জন্য কখনো চেয়েছে সমাজতন্ত্রসহ বহুতন্ত্র। কোন তন্ত্রই মানুষকে স্থায়ী মুক্তি দিতে পারিনি। মানুষের সেই মুক্তি সব তন্ত্রই ব্যর্থ। এখন মানুষ গণতন্ত্র চাই। শুরুতে গণতন্ত্র কিছুটা আশা দেখাতে সক্ষম হলেও গণতন্ত্র এখন মানুষ মানবিকতার সবচেয়ে বড় গলার কাটা। গনতন্ত্রর ঘোরে মানুষ আজ দিশেহারা। তেমনি যাপিত জীবনের সমস্যার কথা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়ে দিয়েছেন। কবি সাইফুদ্দিন সাইফুল লিখেছেন “অপূর্ণ চাওয়া -পাওয়া কেঁদে ফেরে/ নীল হই গনতন্ত্রেও চরিত্র দেখে/ এই কি তবে স্বাধীনতার সার্থকতা”(দিকভ্রান্ত কাল; নীলাম্বর)

মানুষের জন্য পৃথিবীর জন্য কবির হৃদয় বারবার কেঁদে উঠে। মানুষের জন্য মানুষের হৃদয় কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের  আরও মানবিক হতে হবে। আসুন আমরা মানুষ হোই। মানুষের কল্যাণে পৃথিবীতে  কাজ করি । জাত-পাত শ্রেণী গোত্র ভুলে এক মাত্র মানুষের জন্য সৎ কর্ম কর্। আসুন আমরা পৃথিবীটা আমাদের মত করে-মানুষের পৃথিবী করে তুলি।

আরো পড়ুন- বাংলা হাইকু বই আলোচনা

You cannot copy content of this page