ঈর্ষা- অপু চৌধুরী- গল্প

মাঝে মধ্যেই কিছু ভালো লাগে না মীরা’র। চল্লিশে পা দেওয়া মীরা’র সবই তো আছে। স্বামী, সন্তান, সাজানো-গোছানো সংসার। তারপরও আজকাল যেন জীবনের খেই হারিয়ে ফেলছে মীরা।

মীরা কর্মজীবী। মাস শেষে ভালো বেতন পায়। এটা সেটা ইচ্ছে মতো কেনা-কাটা করে। তবুও কেন যেন কখনও কখনও মীরা’র কিচ্ছু ভালো লাগে না। আজ অফিস নেই। তাই অখন্ড অবসর। এমনিতে সেই সাত-সকালে উঠাতে হয় তাকে। সুশান্ত অফিসে যাবার আগে নাস্তা তৈরি করতে হয়। সন্তানকে খাওয়াতে হয়। স্কুলে পাঠাতে হয়। তারপর সময় মতো নিজের অফিসে যাওয়া। তার হাতে সময় থাকে কই?

বেলা এগারটায় বাসা থেকে বের হয়ে মানরু প্লাজায় গেল মীরা। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হবে। এ দোকান ও দোকান ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দেখতে থাকে মীরা। হঠাৎ করেই তার দৃষ্টি আটকে যায়। এ যে সমীর! মীরাকে দেখতে পেয়ে মিটিমিটি হাসছে। মীরাও এক চিলতে হাসি ফোটাল ঠোঁটে।

কি খবর মীরা? ভালো আছো তো? সমীর বলল।

মীরা এ কথার জবাব না দিয়ে সমীরকে দেখছিল। সেই ছিপছিপে চেহারা বেশ ভারী হয়েছে। কিন্তু চোখ দু’টি এখনও অসম্ভব রকমের উজ্জ্বল। ভার্সিটিতে পড়ার সময় সমীরের প্রেমে পড়েছিল মীরা। তাদের সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে পারতো। সমীরও রাজি ছিলো বিয়েতে। ‍শুধু সময় চেয়েছিলো মীরা’র কাছে। এক সময় প্রদীপ-এর সাথে পরিচয় ঘটে মীরা’র। শিল্পপতি বাবার একমাত্র সন্তান প্রদীপ ভার্সিটিতে গাড়ি হাঁকিয়ে আসতো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর ডোনার ছিল প্রদীপ। তখন আস্তে আস্তে সমীরের সাথে সম্পর্কটা শীতল হচ্ছিল। এক সময় তাদের দু’জনার মাঝে জটিলতা তৈরি হল। সমীর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো মীরা’র কাছ থেকে। বছর দু’য়েক পর প্রদীপ মীরাকে কিছু না বলে আমেরিকা পাড়ি জমাল। মীরাও চাকরি নিয়ে মফস্বলে চলে গেল। সেই বার বছর আগের কথা।

কী ব্যাপার মীরা? কথা বলছ না কেন? কি ভাবছো? সমীর ফের বলল।

না মানে, হঠাৎ এই শহরে দেখা হবে ভাবতেই পারিনি। তুমি কেমন আছো? মীরা বলল।

ভালো আছি। দেখে বুঝতে পারছো না।

শুনেছিলাম রাজশাহীতে আছো। এনজিওতে কাজ করছো?

বছর তিনেক হলো কানাডায়। অল্প কিছু দিনের জন্য দেশে এসেছি।

তাই নাকি?

চলো কোথাও গিয়ে বসি। এক কাপ কফি খাওয়া যাবে।

মীরা হাঁটছে সমীরের পাশে। মনে কৌতুহল এক সময়ের প্রেমিক পুরুষ এখনও কী অবিবাহিত আছে? সমীর তার বিরহে বিবাহ করেনি। এমন খবর তো তাকে মালতি দিয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। মীরা ভাবছে অনেক বছর ধরে যার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। সে-ই কি-না আজ তার ভেতরটা তোলপাড় করে দেয় কী এক জাদুতে। কত টুকরো স্মৃতি মনে পড়ছে মীরা’র। সুখের, আনন্দের, ভালোলাগার, ক্রোধের। এত বছর ধরে হৃদয়ের গহীনে ছিলো স্মৃতিগুলো। সোনালি ফাস্টফুডে বসে দু’জনে মুখোমুখি।

কী খাবে বলো? সমীর বলল।

শুধু কফি। মীরা বলে।

একটা আইসক্রিম খাও। তুমি খুব পছন্দ করতে।

বাহ্ মনে রেখেছো তাহলে।

তোমার হাজবেন্ড কী করেন? বিয়েতে দাওয়াত করনি তো।

বিয়েটা অংক কষে করিনি সমীর। চাকরি ভালোই কাটছিল দিনকাল। বাব-মা দুশ্চিন্তা শুরু করলো আমায় নিয়ে। একটি প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে সুশান্ত।

বেশ ভালোই আছো স্বামী-সন্তানদের নিয়ে।

মীরা নীরব থাকে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে।

কী ভাবছো মীরা? সমীর জানতে চায়।

কিছু না তো। তুমি বিয়ে করনি?

সমীর একথার জবাব না দিয়ে হা-হা করে হাসে। সেই পাগল করা হাসি। মীরা ভাবনায় ডুবে যায়। তাহলে কি সমীর তার কথা ভেবে এতো বছর কাটিয়ে দিল। আজ হঠাৎ করেই নিজেকে অপরাধী মনে হয় মীরার।

সমীর, বিয়েটা করেই ফেলনা, এখনো সময় আছে। মীরা বলল।

বিয়ে আমি করেছি মীরা। এবার দেশে এসেছি বউকে সঙ্গে করে কানাডায় নিয়ে যাবে। সমীর বলল। থতমত খেল মীরা। নিমিষেই মুখটা যেন মলিন হয়ে গেল। জোর করেও মুখে হাসি ফোটাতে পারল না। সমীর পকেট থেকে বউ এর ছবি বের করে মীরার হাতে দিল। তারপর বলল, এই শহরে রীতার মামার বাড়ি। আমরা বেড়াতে এসেছি। মীরা আড়চোখে তাকায় ছবির পানে। রীতা’র বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ হতে পারে। শ্যামলা রঙের হলেও মুখটাতে খুব শ্রী আছে। সমীরের পাশে আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না মীরার। তার ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেছে। খুবই অস্বস্তিতে পড়ে গেল মীরা।

তারপর বাসায় কাজ আছে বলে সমীরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিল মীরা। রিকশায় বসে মীরার শরীর কেঁপে উঠেছে। হঠাৎ করেই যেন তার প্রেসার বেড়ে গেল।

বাসায় ফিরে মীরা ফ্যান ছেড়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে। তার মুখে বয়সের ছাপ স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে। মীরা’র বয়স যেন হঠাৎ করেই বেড়ে গেল। মীরা আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লো।

আরও পড়ুন- মাটির টান গল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page